রুপসী খালার গু*দ।bangla choty

❐ রুপসী খালা 

গ্রামের নাম ছিল ধানসিঁড়ি। নদীর কিনারে ঘন সবুজের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু কাঁচা-পাকা বাড়ি। নদীটি যেন গ্রামের প্রাণ, তার পানি বয়ে চলে নিঃশব্দে, কিন্তু তার তীরে জীবনের গল্পগুলো ছিল বেশ জোরালো।

এই গ্রামে থাকতেন রুপসী খালা। তার আসল নাম ছিল রহিমা, কিন্তু তার রূপ আর মিষ্টি হাসির জন্য গ্রামের সবাই তাকে ‘রুপসী খালা’ বলে ডাকত। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি হলেও তার মুখে যৌবনের আলো যেন এখনো ঝলমল করত। কিন্তু রুপসী খালার গল্প শুধু তার রূপের নয়, তার হৃদয়ের গভীরতার।

রুপসী খালার বাড়িটা ছিল গ্রামের শেষ প্রান্তে, নদীর ধারে একটা কাঠের বেড়ার ঘর। ছোট্ট উঠোনে আম আর জাম গাছের ছায়ায় তিনি একা থাকতেন। তার স্বামী আজিজ মিয়া মারা গিয়েছিলেন বছর দশেক আগে, আর ছেলেমেয়ে ছিল না। তবে গ্রামের সবাই তার আপনজন। রুপসী খালার দরজা সবসময় খোলা থাকত, আর তার হাসিমুখে সবাই যেন একটু শান্তি খুঁজে পেত।গ্রামে একটা গুজব ছিল যে রুপসী খালার কাছে নাকি অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কেউ বলত, তিনি দুঃখী মানুষের মনের কথা বুঝতে পারেন। কেউ বলত, তার হাতের রান্না খেলে মনের জ্বালা কমে যায়!


কিন্তু সত্যি কথা হলো, রুপসী খালার ক্ষমতা ছিল তার সহানুভূতি আর শোনার ধৈর্য। তিনি কখনো কাউকে তাচ্ছিল্য করতেন না, আর তার কথায় ছিল একটা অদ্ভুত জাদু—যা মানুষকে আশা দিত।এক শীতের সকালে ধানসিঁড়ি গ্রামে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। গ্রামের পঞ্চায়েতের সভাপতি নুরুল সাহেবের মেয়ে, ফাতেমা, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। ফাতেমা ছিল গ্রামের সবচেয়ে উচ্ছল মেয়ে। সে গান গাইত, নাচত, আর তার হাসিতে গ্রামের মানুষ মুগ্ধ হত। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সে শয্যাশায়ী। ডাক্তার বলল, তার শরীরে কোনো রোগ নেই, তবু সে কথা বলে না, খায় না, শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। নুরুল সাহেব হতাশ হয়ে গ্রামের ওঝার কাছে গেলেন, কিন্তু কোনো কাজ হলো না।

অবশেষে গ্রামের এক বুড়ি, আমেনা খালা, বললেন, “রুপসী খালার কাছে যাও। ওর কথায় ফাতেমার মন খুলে যাবে।”নুরুল সাহেব প্রথমে ইতস্তত করলেন। তিনি ভাবলেন, রুপসী খালা তো শুধু একজন সাধারণ মহিলা, তিনি কী করতে পারবেন? কিন্তু মেয়ের অবস্থা দেখে তিনি শেষমেশ রুপসী খালার বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।রুপসী খালা তখন উঠোনে বসে কিছু শুকনো কাঠ কাটছিলেন।

নুরুল সাহেবকে দেখে তিনি হেসে বললেন, “আরে, নুরুল ভাই, কী খবর? এতদিন পর আমার কুঁড়েঘরে পা রাখলেন?” নুরুল সাহেব লজ্জিত মুখে ফাতেমার কথা বললেন। রুপসী খালা চুপচাপ শুনলেন, তারপর বললেন, “আমাকে ফাতেমার কাছে নিয়ে চলো।”

ফাতেমার ঘরে ঢুকে রুপসী খালা দেখলেন, মেয়েটি বিছানায় শুয়ে আছে, চোখে একটা ফাঁকা দৃষ্টি। তিনি ফাতেমার পাশে বসলেন, তার হাত ধরে আলতো করে বললেন, “মা, আমি তোর রুপসী খালা। আমার দিকে তাকা একটু।” ফাতেমা প্রথমে কিছু বলল না, কিন্তু রুপসী খালার মৃদু হাসি আর উষ্ণ স্পর্শে তার চোখে একটু জল চিকচিক করে উঠল।রুপসী খালা কোনো তাড়াহুড়ো করলেন না।

তিনি ফাতেমার পাশে বসে গল্প শুরু করলেন। তিনি বললেন তার নিজের জীবনের কথা—কীভাবে তিনি ছোটবেলায় নদীর ধারে খেলতে যেতেন, কীভাবে তার স্বামী আজিজ তাকে প্রথম দেখে প্রেমে পড়েছিলেন, আর কীভাবে তিনি জীবনের দুঃখগুলোকে হাসি দিয়ে জয় করেছেন। ফাতেমা চুপচাপ শুনছিল। তারপর রুপসী খালা বললেন, “জানিস, মা, মনের কষ্ট বুকের মধ্যে রাখলে তা পাথর হয়ে যায়। কিন্তু যদি তুই সেই কষ্ট কাউকে বলিস, তাহলে তা হালকা হয়ে যায়, যেমন নদীর পানি বয়ে নিয়ে যায় সব ময়লা।”

ফাতেমার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। সে ধীরে ধীরে মুখ খুলল। সে বলল, তার বিয়ের কথা চলছে একটা ছেলের সঙ্গে, যাকে সে চেনে না। তার বাবা-মা বলছেন, ছেলেটি ভালো, কিন্তু ফাতেমার মনের মধ্যে ভয় আর অনিশ্চয়তা তাকে গ্রাস করছে। সে ভাবছে, তার স্বপ্ন, তার গান, তার নাচ—সব কি বিয়ের পর শেষ হয়ে যাবে?

এই ভয়ে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।রুপসী খালা ফাতেমার কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, “তোর ভয়টা আমি বুঝি, মা। আমারও একসময় এমন ভয় ছিল। কিন্তু জানিস, জীবনের প্রতিটা পথে একটা নতুন গল্প লেখা থাকে। তুই যদি তোর মনের কথা তোর বাবা-মাকে খুলে বলিস, তারা নিশ্চয়ই তোর কথা শুনবে। আর যদি না শোনে, তাহলে আমি আছি তো! আমি গিয়ে তোর বাবার সঙ্গে কথা বলব।”

ফাতেমা অবাক হয়ে তাকাল। রুপসী খালার কথায় তার মনে একটা আলো জ্বলে উঠল। সে প্রথমবারের মতো হাসল। রুপসী খালা তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুই তো আমার মতোই, মা। তোর মধ্যে একটা আগুন আছে। সেটা কখনো নিভতে দিবি না।”পরের দিন রুপসী খালা নুরুল সাহেবের সঙ্গে কথা বললেন।

তিনি ফাতেমার মনের ভয়ের কথা বোঝালেন। নুরুল সাহেব প্রথমে একটু অবাক হলেন, কিন্তু রুপসী খালার কথায় তার মন নরম হলো। তিনি ফাতেমাকে ডেকে বললেন, “তোর যদি বিয়েতে মন না থাকে, তাহলে আমরা আরেকটু সময় নেব। তুই যা চাস, তাই হবে।” ফাতেমার চোখে খুশির ঝিলিক। সে রুপসী খালার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।

রুপসী খালার এই কাজ গ্রামে আরেকটি কিংবদন্তি হয়ে গেল। কিন্তু তিনি কখনো নিজেকে বড় করে দেখাতেন না। তিনি বলতেন, “আমি তো শুধু মানুষের কথা শুনি আর তাদের পাশে থাকি। এটাই আমার কাজ।” গ্রামের মানুষের কাছে রুপসী খালা ছিলেন একজন মায়ের মতো, যিনি শুধু হাসি আর আশা ছড়িয়ে দিতেন।কয়েক মাস পর ফাতেমা আবার গান গাইতে শুরু করল। সে রুপসী খালার জন্য একটা গান লিখল, যার নাম ছিল “নদীর মায়া”।

গানটি শুনে গ্রামের সবাই মুগ্ধ হলো। রুপসী খালা গান শুনে বললেন, “এই গান তো আমার নয়, এ তো তোদের সবার।” তার চোখে জল, কিন্তু মুখে হাসি।ধানসিঁড়ি গ্রামে রুপসী খালার গল্প আজও চলছে। তার বাড়ির উঠোনে এখনো মানুষ আসে, কেউ কষ্ট নিয়ে, কেউ আনন্দ ভাগ করতে। আর রুপসী খালা সেই একই হাসি নিয়ে তাদের পাশে থাকেন, যেন নদীর মতোই—নিঃশব্দে, কিন্তু সবার জীবনে একটা প্রবাহ এনে দিয়ে।

সমাপ্ত📢

#বাংলা #মা #খালা #গল্প

Post a Comment